অনিমেষ ভট্টাচার্য কলকাতার একজন প্রশিক্ষিত ডাক্তারদের মধ্যে একজন. বিলেত থেকে ডাক্তারি জ্ঞান অর্জন করে এসেছেন তিনি. তার পিতা তপন ভট্টাচার্য ছিলেন উকিল. এখন যদিও অবসর নিয়েছেন. তার মা রমলা দেবী গৃহবধূ. অনিমেষ বাবু কলকাতার একটি বিখ্যাত হসপিটালে ডাক্তারি প্রাকটিস করেন. কিন্তু তিনি খুশি নন. ছোট বেলা থেকেই তার মধ্যে গরিব দুঃখীদের সেবা করার, তাদের মুখে হাসি ফোটানোর একটা দৃঢ় ইচ্ছা ছিল. কিন্তু ডাক্তার হয়েও কলকাতায় তিনি নিজের এই ইচ্ছাটা সফল করতে পারছিলেন না. তাকে এখানে রুলস আর রেগুলেশন এর মধ্যে দিয়ে চলতে হয়. তিনি সচ্ছল ভাবে এখানে কাজ করতে পারছিলেন না. কারণ তার মনে সেবা করার ভাবনাটা এখনো রয়ে গেছেন. তিনি তার স্ত্রীকে বলেন : স্নিগ্ধা, যদি সবাই শহরে ডাক্তারি করে.... তাহলে গ্রামের ওই গরিব লোক গুলোর কি হবে বলতো?
স্নিগ্ধা বলে : তুমি একদম ঠিক কিন্তু এখানে তোমার অনেক সুযোগ আছে যেটা ওখানে নেই.
স্নিগ্ধা, দুই সন্তানের জননী. প্রথম জন আট বছরের আর দ্বিতীয় জন এখনো দুধপান করে. অর্ণব আর সুজয়. অর্ণব বড়ো. তাদের মা অসাধারণ রূপের অধিকারিণী. দুই সন্তানের মা হয়েও শরীরে কোনো সৌন্দর্যের অভাব নেই. রমলা দেবী যখন অনিমেষ বাবুকে স্নিগ্ধার ছবি দেখিয়ে ছিল ওই টানা টানা চোখ দেখেই অনিমেষ বাবু হা বলে দিয়েছিলেন. তারা দু পক্ষই বড়ো ঘরের. আজ স্নিগ্ধা আর অনিমেষ বাবু সুখী দাম্পত্য জীবনের অধিকারী কিন্তু তারা জানতেন না এই সুখী জীবনের ওপর নেমে আসবে কালো ছায়া, তাদের দাম্পত্য জীবনে নজর পরতে চলেছে কালো এক ছায়ার.
অনিমেষ বাবু একদিন ঠিক করে ফেললেন না.... আর নয় এইভাবে আর চলতে পারেনা. জীবনে স্বার্থ, অর্থ থেকেও সেবা বড়ো. তিনি এই শিক্ষা তার দাদুর থেকে, বাবার থেকে পেয়ে এসেছেন. তাই তিনি একদিন তার এক বন্ধুরা প্রতুল কে তার মনের কথা বলেই ফেললেন. প্রতুল তাকে জানালো সে যদি চায় তাহলে সে তার মনের ইচ্ছা পূরণ করতে পারে. অনিমেষ বাবু তো হাতে চাঁদ পেলেন. তিনি প্রতুল কে বললেন তিনি রাজি. গরিব মানুষ গুলোর সেবা করে তার আত্ম তৃপ্তি. টাকা পয়সার কোনো অভাব কোনো দিনই ছিলোনা অনিমেষ বাবুর. তাই সেবাতে নিজের মন দিতে চান. নিজের শিক্ষাকে সেবার কাজে লাগাতে চান. প্রতুল তার কথা শুনে বললো : ভাই.... তোর মতো যদি সব ডাক্তার হতো তাহলে......... থাক.... তুই যখন এটাই চাইছিস তখন আমার জানা একটা গ্রাম আছে. ওখানে কোনো ডাক্তার থাকতে চায়না... আসলে সবাই শহরকে আপন করতে চায়. তাই আগের ডাক্তারও দিয়েছে লম্বা. তা তুই ওখান দিয়েই নিজের যাত্রা শুরু কর. অনিমেষ বাবু তো এককথায় রাজি. কিন্তু বাসস্থান তো দরকার, সেই ব্যাপারে প্রতুল কে জিজ্ঞাসা করাতে সে বললো : কোনো অসুবিধা নেই. ওইগ্রামে আমার এক বন্ধুর একটা জমিদার বাড়ি আছে. যদিও সেই বাড়ি আজ পরিত্যক্ত. কিন্তু আমি ওকে বলবো যাতে ও ওখানকার সব কিছু পরিষ্কার করিয়ে রাখে. আসলে ওদের পরিবারই একটা ছোট হাসপাতাল খুলে ছিল কিন্তু ঐযে সব ডাক্তার শহরে পালিয়ে যায়. এবার তুই ভেবে দেখ. অনিমেষ বাবু বললেন সব ব্যাবস্থা যখন হলোই তখন তুই তোর বন্ধুরা সাথে কথা বলে দেখ. দু দিন বাদে ওই বন্ধুর সাথে প্রতুল অনিমেষ বাবুর দেখা করিয়ে দিলেন. তার নাম অঞ্জন ভট্টাচার্য. তিনি বললেন জমিদার বংশের সন্তান তিনি কিন্তু তার জন্ম শহরেই. তিনি নিজে কয়েকবার মাত্র গেছেন ওই গ্রামে. তবে তার বাবার ওই গ্রামে অনেক influence আছে. তাই তার এক কোথায় গ্রামের লোকেরা সব ঠিক থাক করে দেবে.
অঞ্জন : সত্যি আপনার মতো মানুষকে আমি খুজছিলাম. গ্রামের হাসপাতালটা পড়ে আছে, কেউ দেখার নেই. আপনি থাকলে ভালোই হবে. আপনার থাকা খাওয়ার কোনো অসুবিধা হবেনা. পুরো বাড়িটাই আপনারা ব্যবহার করতে পারবেন. কিন্তু.........
অঞ্জন বাবুর কিন্তু শুনে আর একটু চিন্তিত মুখ দেখে অনিমেষ বাবু বললেন : কি হলো অঞ্জন বাবু? একটু চিন্তিত মনে হচ্ছে?
অঞ্জন : আসলে ব্যাপারটা কিছুই নয়. আমরা শহুরে লোক. আমরা যদিও এসব মানিনা. আমার বাবাও মানেনা. কিন্তু গাঁয়ের লোকেরা বলে বাড়িটাতে নাকি গোলমাল আছে.
অনিমেষ : গোলমাল? কি গোলমাল মানে চুরি টুরির কথা বলছেন?
অঞ্জন : আরে না দাদা..... আসলে লোকে বলে বাড়িটা নাকি Haunted. অনেক আওয়াজ ভেসে আসে নাকি..... যদিও আমি ঐসব ফালতু কোথায় কান দিনা. গ্রামের অশিক্ষিত কিছু লোকের ভুলভাল চিন্তাধারা. তবু আপনাকে এই ব্যাপারটা জানানো উচিত বলে আমি বললাম. আপনার কোনো অসুবিধা থাকলে.........
অনিমেষ বাবু অট্টহাসি হেসে উঠলেন. এইসব নিম্নমানের ব্যাপার তিনি মাথাতেই আনেননি. তিনি ভেবেছিলেন বোধহয় গ্রামে চুরি ডাকাতি হয়. তিনি অঞ্জন বাবুকে জানিয়ে দিলেন ঐসব প্রাগৈতিহাসিক চিন্তাধারাতে তার বিশ্বাস নেই. তিনি বিজ্ঞান জগতের মানুষ. তিনি স্পষ্ট ভাবে অঞ্জন বাবুকে জানিয়ে দিলেন তার কোনো অসুবিধা নেই ওই বাড়িতে থাকতে. এতো বড়ো একটা বাড়ি পাওয়া যাবে সেখানে তিনি ভালোই থাকবেন. সব কথার শেষে ঠিক হলো ওই বাড়িতেই থাকা হবে. হায়রে..... মানুষ মাঝে মাঝে এমন কিছু ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে যার ফলাফল হয় ভয়ানক.
তার এই সিদ্ধান্তের কথা যখন তিনি বাড়িতে জানালেন তখন প্রথমে সবাই আপত্তি করলো. বিশেষ করে স্নিগ্ধা. সে অনিমেষ বাবুকে বোঝালো কিন্তু তিনি তার সিদ্ধান্তে অটল. ছোট থেকেই তার মধ্যে সেবা করার একটা ইচ্ছা ছিল আজ সেই সুযোগ পেয়েও তিনি ছেড়ে দেবেন. না কখনোই নয়. শেষ মেশ এটাই ঠিক হলো তিনি যাবেন. এই ব্যাপারে তপন বাবু অর্থাৎ ওনার পিতাও একমত হলেন. তিনিও পরোপকারী মানুষ. ঠিক হলো অনিমেষ বাবু আগে গিয়ে সব সাজিয়ে গুছিয়ে নেবেন. তারপর তিনি সপরিবারে সেই বাড়িতে যাবেন. কিন্তু অনিমেষ বাবুর স্ত্রী স্বামীকে ওই অচেনা জায়গায় একা ছাড়বেনা. আবার ওনার বাবা মায়ের যাওয়া হবেনা. তাদের বেশি বাইরে ঘোরা ঘুরি মানা. তাই ঠিক হলো যে কটা মাস তিনি ওই গ্রামে সেবা করবেন সেই কটা দিন তারা তাদের ছোট ছেলের কাছে চলে যাবেন. ওদিকে অর্ণব এর স্কুলে কয়েকদিন পরেই ছুটি পড়বে. গরমের ছুটি. তখনি রওনা হওয়া যাবে. তাহলে সবাই যেতে পারবে একসাথে. অনিমেষ বাবু সেই মতো বড়ো কর্তাদের জানালেন. সেখানকার বড়ো একজন তাকে সাহায্য করলো তাকে সব কাজে. ঠিক হলো যাত্রার দিন. অঞ্জন বাবুও সস্ত্রীক বাচ্চাদের নিয়ে একেবারে অনিমেষ বাবু কে নিয়ে একবার ঘুরে আসবেন বাড়িটা থেকে. নিজেও দেখে আসবেন বাড়িটা.
এসে গেলো সেইদিন. অনিমেষ বাবু স্ত্রী সন্তানকে নিয়ে বাবা মাকে প্রণাম করে বেরিয়ে পড়লেন ওই বাড়ির পথে. স্টেশনে গিয়ে দেখলেন অঞ্জন বাবু সঙ্গে একটা বাচ্চা. বোধহয় ওনার ছেলে. এগিয়ে গিয়ে পরিচিত হলেন একে ওপরের সাথে. অঞ্জন বাবু বললেন তার স্ত্রীয়ের শরীরটা একটু খাড়াপ তাই তিনি ছেলেকে নিয়েই এসেছেন. তারা ট্রেনে গিয়ে বসলো. দুই বাচ্চা একসাথে বসলো. অঞ্জন বাবুর ছেলের নাম চয়ন. চয়ন আর অর্ণব দ্রুত বন্ধু হয়ে গেলো. ওরা গল্প করতে লাগলো. বড়োরাও গল্প করতে লাগলো. দীর্ঘ 4 ঘন্টার পথ. স্টেশনে যখন গাড়িটা থামলো তখন সন্ধে 6 টা বেজে গেছে. স্টেশনে আগেই বলা ছিল. লোক আগেই ওনাদের নিতে এসেছে. অর্ণব দেখলো একজন বুড়ো লোক সঙ্গে দুজন কুলি. অঞ্জন বাবু পরিচয় করিয়ে দিলেন ওনার সঙ্গে. উনি গ্রামের একজন বিশিষ্ট মানুষ. নাম জগবন্ধু দাস. ওনার সঙ্গে অঞ্জন বাবুর বাবা মিলেই ওই হাসপাতাল বানিয়ে ছিলেন.
জগবন্ধু বাবু বললেন : এই গ্রামে নিজের থেকে যে কোনো ডাক্তার আসবে সেটা তিনি ভাবতেই পারেননি. তিনি বললেন আজতো সন্ধে হয়ে গেছে তাই কাল অনিমেষ বাবুর উদ্দেশে একটি স্বাগতম অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়েছে. ওই একটু বক্তৃতা আর ওনার সম্মানে একটু মিষ্টি বিতরণ. জগবন্ধু বাবু কুলিদের বললেন সব মল পত্র ঠিক মতো গাড়িতে তুলে দিতে . তিনি আগেই গরুর গাড়ির ব্যবস্থা করে রেখে ছিলেন. তিনি সকলকে নমস্কার বলে চলে গেলেন. সবাই দুটো গরুর গাড়িতে চড়ে আসতে লাগলেন. 10 মিনিটের মধ্যেই তারা ওই বাড়িটাতে পৌঁছে গেলেন. বাড়িটা বিশাল কিছু না হলেও বেশ বড়ো. তিন তলা. টিপ টিপ করে হারিকেনের আলোয় জানলা গুলো আলোকিত. অঞ্জন বাবু নেমে হাঁক পারলেন. আর দুইজন লোক বেরিয়ে এলো. একজন মেয়েমানুষ আরেকজন লম্বা করে লোক. অঞ্জন বাবু ওনাদের সঙ্গে অনিমেষ বাবুর পরিচয় করিয়ে দিলেন. মেয়েমানুষটির নাম মালতি আর লোকটি তার বর তপন. দুজনেই পেন্নাম করলো তাদের. অর্ণব দেখলো তপন লোকটি কেমন করে যেন তার মায়ের দিকে চেয়ে আছে. ওর মা লক্ষ্য করছেনা কারণ সে অনিমেষ বাবুর সঙ্গে কথা বলছে. তপন ওদের মল পত্র নিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলো আর পেছনে ওরা. মালতি ওদের জন্য কিছু জল আর খাবারের ব্যবস্থা করতে গেলো.
স্নিগ্ধা ওনার স্বামীকে বললো : বাব্বা..... জায়গাটা কি থম থমে গো. আসে পাশে সেইরকম বাড়ি ঘোরও নেই. ভাগ্গিস ইলেকট্রিক ব্যবস্থা আছে. নইলে এই জায়গাতে থাকতে কি করে?
অঞ্জন বাবু হেসে বললো : আসলে বৌদি কি এই বাড়িতে কেউতো থাকতো না...... ওই মালতি আর ওর বর বাড়ির থেকে দূরে ওই গ্রামে থাকে. আপনাদের জন্যই ওদের ডেকে পাঠালাম. ওরাই আমাদের বাড়িটার দেখভাল করে. আমরা যখনি আসি ওরাই আমাদের রান্না বান্না করে দিতো. তবে ওদের আমি বলে দিয়েছি এলং থেকে এই বাড়ির নিচেই থাকতে হবে. আপনাদের নতুন জায়গাতে তো এইভাবে একা ছেড়ে দিতে পারিনা. চলুন....
ওনাদের ওপরে দোতলায় থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে. অর্ণব দেখলো চয়ন কেমন করে ঘরটা দেখছে. যেন কিছু একটা ভয় পাচ্ছে. দোতলায় মাল পত্র রেখে সবাই বাইরে বারান্দাতে বসলো. একটু পরেই মালতি কিছু নিমকি আর মিষ্টি নিয়ে এলো. অঞ্জন বাবু জিজ্ঞেস করাতে মালতি বললো রাতের জন্য মুরগি আর লুচির ব্যবস্থা করা হয়েছে. সবাই বসে গল্প করতে লাগলো. চয়ন আর অর্ণব খেলতে লাগলো. দুজনে কম সময়েই বন্ধু হয়ে গেছে.
স্নিগ্ধা : বুবাই (অর্ণবের ডাক নাম) পরে খেলবে আগে খেয়ে নাও.
তারা খেলা ছেড়ে খেতে লাগলো নিমকি. গল্প করতে করতে রাত 10 টা বেজে গেলো. মালতি বললো খাবার ব্যাবস্থা করা হয়েছে. সবাই নীচে রান্না ঘরের পাশে খাবার ঘরে গেলো. সেখানে একটা পুরোনো খাবার টেবিল আছে. আর 4টা চেয়ার. বাচ্চারা দাঁড়িয়ে খেলতে খেলতে খেতে লাগলো. স্নিগ্ধা বুবাই কে খাইয়ে দিচ্ছে ওদিকে অঞ্জন বাবু চয়ন কে. মালতি বেশ ভালোই রান্না করে. খাবার পর অঞ্জন বাবু নিচ তোলাটা ওদের ঘুরিয়ে দেখালো. একটা ঘরে ওই মালতি আর তপন. আর বাকি ঘোর গুলোতে পুরোনো মল পত্র.
অনিমেষ বাবু অঞ্জন বাবুকে বললেন : এই বাড়ি কার বানানো?
অঞ্জন বাবু একটা সিগারেট ধরালেন আর বললেন : আমার দাদুর দাদু. অমর ভট্টাচার্য. লোকটা বেশ দিল দরিয়া ছিল.... কিন্তু তার ছেলে একেবারে বিপরীত.
অনিমেষ : মানে?
অঞ্জন : সে কালকে বলব. আজ অনেক খাটাখাটনি গেছে. বৌদি বাচ্চার নিশ্চই ঘুম পেয়েছে. চলুন.... চলুন.
সবাই উপরে উঠে এলো. তখনি কোলের বাচ্চাটা কেঁদে উঠলো. স্নিগ্ধা অনিমেষ আর অঞ্জন বাবুকে শুভরাত্রি বলে ঘরে চলে গেলো. তাকে এখন বাচ্চাটাকে দুধ খাওয়াতে হবে. বাচ্চারা অঞ্জন বাবুর ঘরটাতে বসে একটা ফুটবল নিয়ে. বাইরে তাদের বাবারা সিগারেট টানছে আর গপ্পো / আড্ডা মারছে. অর্ণব দেখলো চয়ন তাকে কিছু একটা বলতে চাইছে কিন্তু কেন যেন চেপে যাচ্ছে. তখনি স্নিগ্ধা ঘর থেকে ওদের শুতে আসতে বললো. অনিমেষ বাবু অঞ্জন বাবুকে শুভরাত্রি বলে ছেলেকে নিয়ে চলে এলো ঘরে. সারাদিন যাত্রার ধক এ সবাই ক্লান্ত. জামা কাপড় বদলে সবাই শুয়ে পরলো. স্নিগ্ধা আগেই শাড়ি পাল্টে একটা ম্যাক্সি পরে নিয়েছে. সবাই শুয়ে পরলো. আর একটু পরেই ঘুম. রাত গভীর. বাইরে শেয়াল ডাকছে. জানলা দিয়ে চাঁদের আলো ঘরে ঢুকে ঘর আলোকিত. পাখা ঘুরছে. খাটের দুপাশে অনিমেষ আর স্নিগ্ধা. মাঝখানে দুই সন্তান. হটাৎ বুবাইয়ের ঘুমটা কেন যেন ভেঙে গেলো. ও চোখ খুলতেই দেখলো কে যেন ওর ডান পাশে দাঁড়িয়ে. ওই পাশেই ওর মা ঘুমোচ্ছে. বুবাই একটু নড়ে উঠতেই আর কিছু দেখতে পেলোনা. ও ভাবলো চোখের ভুল তাই আবার চোখ বুজলো. ওদিকে পাশের ঘরে চয়ন ঘুমিয়ে তার বাবার সাথে. তারা কালকেই চলে যাবে সন্ধে বেলায়. চয়ন তাড়াতাড়ি মায়ের কাছে যেতে চায়. সে এইবাড়িতে বেশিক্ষন থাকতে চায় না.
পরের দিন সকালে সবাই উঠে চা খাচ্ছে. অর্ণব আর চয়ন বাইরে বাগানটা ঘুরে ঘুরে দেখছে. যদিও বাগানটি ঠিক করে পরিচর্যা করা হয়না. কেই বা করবে. তাই সুন্দর ফুল গুলোকে উপেক্ষা করে জংলী গাছ আর জংলী ফুল গজিয়ে উঠেছে. তাদের মাঝে ওই ফুল গুলোর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য চাপা পরে গেছে. ওরা বাগানটা ঘুরে দেখে যেই ফেরার জন্য ঘুরেছে ওরা দেখলো ওদের পেছনে তপন দাঁড়িয়ে আছে. ওদের দিকে চেয়ে হাসছে. সে এগিয়ে এসে বললো : কি খোকাবাবুরা..... বাগান দেখছো? দেখো দেখো. তারপর চয়নের কাছে গিয়ে ওর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বললো : তা এইবার এতো পরে এলে খোকাবাবু? তোমার কথা কত ভাবতাম আমি. তা তোমার মা এলোনা কেন? উনি আসলে আরো ভালো লাগতো. কি তাইনা? বলে বাগানের পাশের রাস্তা দিয়ে কোথায় চলে গেলো. অর্ণব চয়নের দিকে তাকালো. ও দেখলো চয়নের চোখে মুখে কেমন একটা ভয়. ও চয়ন কে কিছু বলতে যাচ্ছিলো তখনি ওর মা ওদের ডাক দিলো. ওরা যেতেই মালতি ওদের জন্য লুচি তরকারি নিয়ে এলো. ওরা চুপচাপ খেতে লাগলো. অঞ্জন বাবু চা খেতে খেতে স্নিগ্ধা কে বললো : তা বৌদি.... কাল কোনো অসুবিধা হয়নি তো? আসলে নতুন জায়গা তো সেইজন্যে. স্নিগ্ধা হেসে বললো : না... না কোনো অসুবিধা হয়নি খুব ভালো ঘুম হয়েছে. নতুন জায়গায় সচরাচর আমার ঘুম আসেনা কিন্তু কাল খুব ভালো ঘুম হয়েছে. একটু পরেই চা খাওয়া হয়ে গেলে অঞ্জন বাবু আর অনিমেষ বাবু বেরোনোর জন্য তৈরী হয়ে নিলেন. একটু পরে দুজনে বেরিয়ে গেলেন. জগবন্ধু বাবু ওনাদের জন্য গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলো. ওদিকে স্নিগ্ধা ছোট ছেলেকে নিয়ে ওপরে চলে গেলো আর দুই বাচ্চা দালানে ফুটবল খেলতে লাগলো. ওরা খেলছে তখনই অর্ণব দেখলো তপন ছুট্টে ঘরে ঢুকে উপরে উঠে গেলো. চয়নও সেটা দেখলো. তারপর তারা আবার খেলতে লাগলো. ওদিকে অঞ্জন বাবু আর অনিমেষ বাবু হাসপাতালে পৌঁছে দেখলো তাদের জন্য জগবন্ধু বাবু আর বেশ কয়েকজন সেখানে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে. সেখানে গ্রামের অনেক লোক এসেছেন. নতুন ডাক্তার বাবুকে পেয়ে তারা খুব খুশি. মালা পরিয়ে তাকে সম্মান জানানো হলো. গ্রামের বিশিষ্ট কিছু মানুষ তাকে সম্মান জানালেন তার সাথে অঞ্জন বাবুকেও. কারণ এই হাসপাতাল বানাতে তাদের পরিবারের অনেক অবদান আছে. অনিমেষ বাবু গ্রামের লোকেদের উদ্দেশ্য কিছু বক্তৃতা দিলেন. তারপর সামান্য মিষ্টিমুখ হলো. সবশেষে হাসপাতাল ভালো ভাবে ঘুরে দেখার পর দুপুর বেলাতে সব লোক চলে গেলে অনিমেষ বাবু, অঞ্জন বাবু, জগবন্ধু বাবু আর গ্রামের প্রৌঢ় অচিন্ত বাবু বসে আড্ডা দিচ্ছে. হটাৎ অচিন্ত বাবু প্রশ্ন করলেন : অঞ্জন তুমি ডাক্তার বাবুকে তোমার ওই জমিদার বাড়িতে রেখেছো ভালো কথা কিন্তু.......
অনিমেষ বাবু হেসে বললেন : আপনি কি ভুতের ভয়ের কথা বলছেন? স্যার আমি ওসব মানিনা. আমি ওই বাড়িতেই থাকবো. আমার বা আমার পরিবারের কোনোই অসুবিধা হবেনা.
জগবন্ধু বাবু একটু চিন্তিত হয়ে বললেন : সে সব ঠিক আছে. আমি আপনাকে থাকতে বারণ করছিনা.... আসলে অচিন্ত বাবু বলতে চাইছেন বাড়িটা নিয়ে যেভাবে গ্রামের লোকেরা বলাবলি করে তার ওপর অনেক দুর্ঘটনা ঘটে গেছে বাড়িটার ওপর দিয়ে.
অনিমেষ : কি দুর্ঘটনার কথা বলছেন.
অচিন্ত : বাবা অঞ্জন.. তুমিই বলোনা. তোমাদের বাড়ি... আমি বলাটা ঠিক হবে না.
অঞ্জন বাবু : আমি বাবার মুখে যতটা জানি তাই বলছি. আমার জন্ম কলকাতায় তাই আমি এই বাড়ির সঙ্গে আমার কোনো অতীত জড়িয়ে নেই. বাবা এখানেই বড়ো হয়েছে. হা এটা ঠিক এই বাড়িতেই অনেক অঘটন ঘটে গেছে. আমার বাবার দাদা মানে আমার জেঠু তার ছোটবেলাতেই এই বাড়িতেই মারা যান. তাছাড়া ঐযে বলেছিলাম আমার দাদুর দাদু তার ছেলে অরিন্দম ভট্টাচার্য ছিল খুব রাগী স্বভাবের মানুষ. সে নাকি কাকে খুন করেছিল. তাছাড়া এই বাড়িতে নাকি বাচ্চাদের বলি দেওয়া হয়েছে. যদিও আমি সেসব ভালো ভাবে জানি না.
অচিন্ত বাবু : আমি জানি..আমি বলছি. অমর ভট্টাচার্যের ছেলে অরিন্দম ছিল রাগী স্বভাবের. কিন্তু বাবা ছিল শান্ত হাসি খুশি স্বভাবের আর ভগবানে বিশ্বাসী মানুষ. ছেলের যখন বিয়ের বয়স হলো তখন তাকে পাশের গ্রামের এক সুন্দরী মহিলার সাথে বিবাহ দিয়েছিলেন. তার বৌমার নাম ছিল সুজাতা. খুব সুন্দরী ছিল সে. একবার অমর বাবু এক সন্ন্যাসী গোছের মানুষকে এই বাড়িতে নিয়ে আসেন. পরে অবশ্য জানা গেছিলো সে তান্ত্রিক. পিশাচ সিদ্ধ. সব রকমের কু কাজে যুক্ত. অনেক শক্তি ছিল নাকি তার. তখন অবশ্য কেউ কিছু জানতোনা. অমর বাবু ভক্তি ভাব নিয়ে তাকে নিয়ে আসেন. তার ছেলের যদিও এইসবে মনোযোগ ছিলোনা. অমর বাবু তার বৌমাকেই বলেছিলো বাবাজির সব রকমের খাবার দাবারের ভার নিতে. সুজাতা সেই মতো বাবাজির সেবা করতো. এক সময়ে অরিন্দম দেখলো তার স্ত্রী ওই বাবাজির একটু বেশিই খেয়াল রাখছে. নিজেই সব খাবার দিয়ে আসে, খাবার পর নিজেই সেই সব পাত্র আনতে যেত. অরিন্দমের সেসব ভালো লাগতোনা. ততদিনে তাদের একটা মেয়ে হয়েছিল. তবে অমর বাবু চাইতেন যেন বৌমার একটা ছেলে হয়. ওই তান্ত্রিক তাকে আশ্বাস দিয়ে ছিল যে তার বৌমার ছেলে হবে. তবে তাকে নাকি বড়ো যোগ্য করতে হবে. এই কাজে তাকে তার বৌমাকে আর তার মেয়েকে লাগবে. আর যতক্ষণ যোগ্য চলবে কেউ যেন ওই ঘরে না আসে. অমর বাবু রাজি হন. ওদিকে অরিন্দম এইসব ভন্ডামিতে একটুও বিশ্বাস করতোনা. সে ঠিক করলো সে লুকিয়ে ওই যোগ্য দেখবে. অবশেষে যজ্ঞের দিন এলো. রাতের বেলা নিচের যে ঘরে তান্ত্রিক থাকতো সেই ঘরেই যোগ্য শুরু হয়. সারারাত নাকি যোগ্য হবে. সবাই শুয়ে পড়েছে কিন্তু অরিন্দম জেগে ছিল. সে ভেবেছিলো ওই ভন্ড লোকটার ভণ্ডামি সবার সামনে নিয়ে আসবেন. সেই মতো তিনি চুপ চাপ উঠে নীচে নামেন. নীচে এসে সে তান্ত্রিকের ঘরের কাছে এসে তার স্ত্রীয়ের গোঙানি শুনতে পান. তিনি দৌড়ে গিয়ে দরজায় লাথি মেরে খোলেন আর যা দেখেন তা ছিল বীভৎস. তার একমাত্র মেয়ের মৃতদেহ পরে আছে আর তার স্ত্রী সুজাতা আর তান্ত্রিক নোংরামো করে চলেছে. নিজের স্ত্রীকে ওই ভাবে তান্ত্রিকের সাথে দেখে রাগী অরিন্দম আরো রেগে যায় আর তান্ত্রিক কে গুলি করে মারেন. ওদিকে তান্ত্রিক নাকি মরার আগে বলে যায় তার এতদিনের কাজে বাঁধা দিয়ে সে ঠিক করেনি তান্ত্রিক বলে সে এইবাড়ির মহিলাদের ছাড়বেনা.... তার যোগ্য সে পূর্ণ করেই ছাড়বে. তার মৃত্যু নেই. সে বার বার ফিরে আসবে. এদিকে স্ত্রীয়ের জ্ঞান ফিরতেই সে এইসব দেখে অজ্ঞান হয়ে যায়. পরে জানা যায় তান্ত্রিক তার শক্তি বাড়ানোর জন্য ছোট বাচ্চাদের বলি দিতো. এখানে এসে সুজাতা আর তার বাচ্চাকে দেখে তার সেই ইচ্ছা বেড়ে যায়. একদিকে নতুন বাচ্চা আরেকদিকে সুজাতার রূপে তান্ত্রিক পাগল. সে ঠিক করে সুজাতাকে বশ করে তাকে ভোগ করবে আর সুযোগ বুঝে তার বাচ্চাকে বলি দেবে. কিন্তু তার পরিকল্পনা পূর্ণ হবার আগেই অরিন্দম তাকে খুন করে. সবাই বলে সেই তান্ত্রিক এর আত্মা আজও নাকি এইবাড়িতে ঘোরাফেরা করে.
সব শুনে অনিমেষ বাবু বললেন : বুঝলাম.... বাড়িটাতে এরকম একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে আর তাই লোকেরা মনে করে ভুত ঘুরে বেড়ায়. যতসব কুসংস্কার. আমি এসব মানিনা. আরেকটা কি দুর্ঘটনার কথা বলছিলেন.
অঞ্জন বাবু বললো : ওটা আমি বলছি. আমার বাবারা ছিল তিন ভাই. বাবা মেজো. ছোটকা কলকাতায় থাকে. জেঠু তার ছোটবেলাতেই মারা যান. বাবা তখন ছোট বোধহয় 6 বছরের মতো আর জেঠু 11 বছরের. সব ঠিকই ছিল কিন্তু কি করে যে একদিন সব কিছু গোলমাল হয়ে গেলো কেউ জানেনা. অরিন্দম তার মেয়েকে হারানোর পরে আবার বাবা হয়েছিলেন. এবারে দুই ছেলে হয়েছিল. তার নাম ছিল সুজিত ভট্টাচার্য আর রঞ্জন ভট্টাচার্য. রঞ্জন আমার দাদু কিন্তু সুজিত ছিল নাকি পাগল. মানে পরে পাগল হয়ে গেছিলো. তাকে ঘরে আটকে রাখা হতো . অনেকে বলে সেই নাকি জেঠুকে মেরে ছিল তখন থেকেই তার পাগলামি ধরা পড়ে. তবে কোনো প্রমান নেই বলে সে ছাড়া পেয়ে যায়. তারপর দাদু বাবা আর ছোটকাকে নিয়ে এই বাড়ি ছেড়ে দেয়. দাদু কর্মসূত্রে আগে বাইরেই থাকতেন. সুজিত একাই থাকতো এই বাড়িতে. সে বিয়ে করেনি. পরে একদিন সে মারা যায় বুড়ো হয়ে. অনেকে বলে সুজিত নাকি ওই তান্ত্রিক দ্বারা possessed ছিল. আমি বা বাবা যদিও এসব মানি টানি না. সে পরে পাগল হয়ে গেছিলো এটা হতেই পারে.
অনিমেষ : একদমই তাই. এই গ্রামে এরকম অনেক ঘটনা রটে যায়. যাকগে..... চলুন... এবার ফিরি. বিকেল হয়ে এলো. অনিমেষ বাবু আর অঞ্জন বাবু ওনাদের বিদায় জানিয়ে ফিরতে লাগলো. ওদিকে চয়ন তার একটা ঘটনা অর্ণব কে বলছে. তারা খেলছিল আর গল্প করছিলো. হটাত চয়ন বললো : তুমি তোমার মাকে বলো ওই তপন এর সাথে যেন বেশি কথা না বলে.
অর্ণব : কেন?
চয়ন : লোকটাকে আমার একদম ভালো লাগেনা. আমরা যখন আগের বছর এখানে এসে ছিলাম তখন লোকটাকে দেখতাম খালি মায়ের দিকে কেমন করে তাকাতো. আমার কেমন যেন লাগতো. মা যখন রান্না করতো তখন আমি প্রায় দেখতাম লোকটা রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে দেখতো. আমরা 10 দিন মতো ছিলাম কিন্তু শেষের কটা দিন মা যেমন কেমন হয়ে গেছিলো. কি যেন ভাবতো. আমার মনে আছে যেদিন আমরা এসেছিলাম তার পরেরদিন রাতের ঘটনা. আমি বাবা আর মা ঘুমিয়ে আছি. হটাৎ আমার ঘুমটা ভেঙে গেলো. চোখ খুলে দেখি মা কি যেন বলে চলেছে. আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না. কিন্তু কয়েকটা কথা বুঝতে পেরে ছিলাম. না....... আমি আর পারছিনা..... এবার আসুন...... আমার কাছে. এরমকম কিছু শব্দ. তারপরের দিন রাতেও মা এরকম বলছিলো. আমি মাকে জিজ্ঞাসা করলাম কি হয়েছে মা? মা হটাৎ ঘুম থেকে জেগে বললো : কৈ কিছু নাতো. তারপর ফেরার 2 দিন আগে আমি ঘুমোচ্ছি. হটাৎ কে যেন বললো ওঠো. তাড়াতাড়ি ওঠো. চলে যাও এখন থেকে. আমি ঘুম ভেঙে উঠে বসলাম. দেখি বাবা ঘুমোচ্ছে. মা পাশে নেই. আমি ভাবলাম বোধহয় বাথরুমে গেছে. কিন্তু অনেক্ষন না ফেরায় আমি ভাবলাম যাই. বাবাকে দেখলাম কিন্তু বাবার ঘুম খুব কড়া. তাই একাই বেরোলাম. দেখি বাইরের হারিকেনটা নেই আর নীচে কলঘরের দরজার ফাঁক দিয়ে একটা আলো আসছে. আমি বুঝলাম মা নীচে তাই ঘরে ফিরে আসছি হটাৎ মায়ের তীব্র চিৎকার. তারপর মাটিতে জল পড়ার শব্দ হলো. আমি বাবাকে ডাকতে যাবো তখনি দেখি দরজা খুলে বেরিয়ে এলো ওই তপন লোকটা. তারপর পেছন ফিরে কাকে দেখে হাসলো তারপর আড়মোড়া ভেঙে কোথায় চলে গেলো. আমি দাঁড়িয়ে রইলাম. একটু পরে দেখি মা ওই কলঘর থেকে বেরোলো. আর ওপরে উঠতে লাগলো. আমি ছুটে গিয়ে ঘরে শুয়ে পড়লাম. মা একটু পরে আমার পাশে শুয়ে পরলো. পরের দিন সকালে দেখি মা আর মালতি মাসি রান্না করছে আর তপনও ওদের সাথে গপ্পো করছে. আমাকে দেখে ওই তপন কেমন যেন রেগে তাকালো তারপর চলে গেলো. লোকটা যেন কেমন. পরের রাতে আমার ঘুম যদিও ভাঙেনি কিন্তু মনে হচ্ছিলো কে যেন বলছে আমায় চলে যাও.... তোমার মাকে নিয়ে চলে যাও. আমি ভাবলাম স্বপ্ন দেখছি. তারপর দিন সন্ধেবেলা আমাদের আসার কথা. বাবা গেছিলো ওই হাসপাতালে ঘুরতে. আমি একা ঘরে খেলছি. হটাৎ মনে হলো কে যেন ঘরে ঢুকলো. আমি এদিক ওদিক দেখলাম কিন্তু কিচ্ছু দেখতে পেলামনা. হটাৎ মনে হলো কানে এসে কে যেন বললো : তোমার মাকে বাঁচাও. আমি আবার এদিক ওদিক দেখলাম তারপর ভয় পেয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম. তারপর মা মা করে মাকে খুঁজতে লাগলাম. কিন্তু মা ওপরে ছিলোনা. আমি একতলায় এসে মা মা করে ডাকতে লাগলাম. দেখি ওই যে ঘরটা দেখতে পাচ্ছ ওই ঘরটা থেকে তপন বেরিয়ে এলো. তারপর মাকে দেখলাম বেরিয়ে আসতে. দুজনেরই সেকি হাসাহাসি. হটাৎ আমাকে দেখে মা রেগে মেগে এগিয়ে এলো তারপর বললো : নীচে কি করছিস? যা ওপরে যা. আমি আসছি. এতো ভীতু কেন তুই. পেছন থেকে তপন বললো : মায়ের কথা শোনো খোকাবাবু. দুস্টুমি করোনা. তারপর মা আমাকে বললো : যা ওপরে আমি তপনের সাথে কয়েকটা কথা বলেই আসছি. আমি ওপরে চলে এলাম. আমি অবাক হলাম. মা এখানে এসে প্রথমদিন তপনের সাথে কোনো কথাই বলেনি তাহলে আজ এতো কি কথা. তারপর দুপুরে বাবা ফিরে এলো. আর সন্ধেবেলা আমরা ফিরে এলাম. তবে মা বাবাকে বলছিলো আরো কদিন থেকে যেতে কিন্তু বাবা রাজী হয়নি. ফিরে এসে মাকে কদিন কেমন যেন মন মরা দেখতাম. তারপর বাড়িতে যেদিন পুজো হলো সেদিন থেকে দেখি মা আবার হাসি খুশি. তাই বলছিলাম কেন জানিনা ওই লোকটাকে আমার ভালো লাগেনা. তুমি তোমার মায়ের সাথে ওকে বেশি মিশতে দিওনা. এই বলে ওরা আবার খেলতে লাগলো. একটু পরেই ওদের বাবারা ফিরে এলো. দুপুরে ওরা খেয়ে দিয়ে একটা ঘুম দিলো. সন্ধে বেলায় অঞ্জন বাবু আর চয়ন ওদের বিদায় জানিয়ে চলে গেলো. রাতে মালতি মাংস আর ভাত রান্না করেছিল. খেতে খেতে কথাবার্তা হচ্ছিলো.
অনিমেষ বাবু বললেন : আমার তো জায়গাটা বেশ লাগলো. এখানে আমি ভালোভাবেই কাজ করতে পারবো. বুবাইটার এখন গরমের ছুটি. সেকটা দিন ও এখানে থাকবে তারপর ওকে বাবা মায়ের কাছে রেখে আসবো.
খাওয়া দাবার পরে মা বাবা বসে বারান্দায় গল্প করছে. বুবাই ঘরে বসে টিভি দেখছে. এখানে সব রকম ব্যাবস্থায় অঞ্জন বাবু করে দিয়ে গেছেন.
বুবাইয়ের মা অনিমেষ বাবুকে বললো : হা জায়গাটা বেশ ভালোই তবে...... কি জানতো... আমার কেমন যেন লাগছে. জানিনা কিভাবে নেবে তুমি ব্যাপারটা কিন্তু তুমি চলে গেছিলে সকালে. আমি একা ছিলাম বাচ্চা দুটো নীচে খেলা করছিলো. আমি বসে টিভি দেখছি আর ছেলেকে দুধ খাওয়াচ্ছি হটাৎ মনে হলো আমার পেছনে কে যেন হাত রাখলো. আমি ঘুরে দেখলাম কিন্তু কেউ নেই. আমি ভাবলাম মনের ভুল. তারপর দুপুরে ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে স্নান করতে গেছি স্নান করছিও হটাত মনে হলো আমার পিঠে কার যেন হাত আবার. আমি ঘুরে তাকালাম কিন্তু কিচ্ছু নেই. কি হলো বলতো?
অনিমেষ বাবু হেসে বললো : আরে ধুর...... তুমিও না. নতুন জায়গায়. নতুন পরিবেশ. সব কিছুই নতুন. তাই এসব মনে হচ্ছে. দেখবে ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে. অনিমেষ বাবু আজ যা শুনেছেন তার কিছুই স্নিগ্ধাকে জানালেন না. যদি আরো ভয় পেয়ে যায় তাই. একটু পরেই গল্প শেষে অর্ণবের বাবা এসে ওকে যে কথাটা বললো সেটা শুনে ওর খুব ভয় হলো.
বুবাই টিভি দেখছিলো. ওর বাবা এসে বললো : বুবাই তুই ওই পাশের ঘরটায় থাকতে পারবি? আসলে এই খাটটায় চার জন ধরছে না. তাছাড়া তুমি বড়ো হচ্ছ. আজ বাদে কাল তোমায় ওই বাড়িতেই দাদু দিদার সাথেই থাকতে হবে আমরা তো এখানে থাকবো. যদিও স্নিগ্ধা বললো একসাথেই শুতে কিন্তু এটা ঠিক ওই খাটে চার জন ধরে না. তাই শেষ মেশ ঠিক হলো ও একাই ওই ঘরে শোবে. তাই সেইমতো ওই ঘরে সবার ব্যবস্থা করা হলো. রাতে একা একা শুতে বুবাইয়ের ভয় হচ্ছিলো. তবে সেরাতে তার কোনো অসুবিধা হলোনা. পরের দিন সকালে উঠে সে তৈরী হয়ে বাইরে এলো. বাইরে এসে দেখলো বাবা বেরোচ্ছে. ছেলেকে টাটা করে অনিমেষ বাবু চলে গেলেন নিজের কাজে. বুবাই কে মালতি এসে খেতে দিয়ে গেলো. লুচি আর বেগুন ভাজা. সে খেতে লাগলো আর টিভি দেখতে লাগলো. স্নিগ্ধা বললো : বুবাই ভাই রইলো. আমি বাথরুমে যাচ্ছি. বলে সে নীচে চলে গেলো. বুবাইয়ের কিছুক্ষন পরেই খাওয়া শেষ হয়ে গেলো. সে হাত ধুয়ে প্লেট রেখে ভাইকে দেখে নিলো সে ঘুমোচ্ছে. তারপর ওপরে তিন তোলাটা ঘুরতে গেলো. ওপরে যেতেই দেখলো তপন একটা ঘরে কি যেন করছে. সে এগোতেই দেখলো তপন বেরিয়ে আসছে. তাকে দেখে তপন হেসে উঠলো. কি খোকাবাবু এখানে কি করছো? এখানে উঠনা. এখানে ভুত আছে হি... হি.... বলে সে চলে গেলো. সে দেখলো তপনের হাতে কালো মতো কি একটা ছিল. সে অতটা খেয়াল করলোনা. সে একটু ঘুরে ফিরে নীচে নেমে এলো. এসে দেখলো মা এখনো আসেনি. সে বারান্দায় দাঁড়ালো. বারান্দা দিয়ে নীচে বাথরুমের কিছুটা দেখা যায়. বুবাই দেখলো তপন এদিক ওদিক দেখে কল পরের পেছনের দিকে চলে গেলো. সে ঐখানটাতে দেখতে এতো ব্যাস্ত যে পেছনে আরেকজন এসে দাঁড়িয়েছে সেটা সে বুঝতেও পারেনি. সে ঘুরতেই চমকে উঠলো. একটা বাচ্চা তার থেকে একটু বড়োই হবে. তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে. হাসছে. বুবাই ভয় পেয়ে গেলো.
সে বললো : কে..... কে.... তুমি.
ছেলেটি বললো : আমি রাজু. এই বাড়িতে আগে থাকতাম. এখন অনেক দূরে চলে গেছি. মাঝে মাঝে এই বাড়িতে ঘুরতে আসি. তা দেখলাম তোমরা নতুন এসেছো. তাই এলাম গল্প করতে. তুমি কি দেখছিলে?
বুবাই বললো কৈ কিছুনা তো?
রাজু হেসে বললো আমি জানি তুমি ওই তপনকে দেখছিলে তাইতো?
বুবাই বললো : তুমি কিকরে জানলে.
রাজু বললো : আমি জানি. তোমার জায়গায় একদিন আমিও ছিলাম. আমার সাথে আমার ছোট ভাই. তারপর......
বুবাই : তারপরে? তারপরে কি গো?
রাজু বললো : শুনবে?
বুবাই : হা বলোনা. বলোনা.
রাজু : তাহলে ছাদে চলো. এখানে নয়.
দুজনে ছাদে যেতে লাগলো. ছাদ খোলাই ছিল. বুবাই আর রাজু ছাদে একটা জায়গায় গিয়ে বসলো. বুবাই তাকে গল্পটা বলতে বললো. সে শুরু করলো তার কাহিনী.
অনিমেষ ভট্টাচার্য কলকাতার একজন প্রশিক্ষিত ডাক্তারদের মধ্যে একজন. বিলেত থেকে ডাক্তারি জ্ঞান অর্জন করে এসেছেন তিনি. তার পিতা তপন ভট্টাচার্য ছিলেন উকিল. এখন যদিও অবসর নিয়েছেন. তার মা রমলা দেবী গৃহবধূ. অনিমেষ বাবু কলকাতার একটি বিখ্যাত হসপিটালে ডাক্তারি প্রাকটিস করেন. কিন্তু তিনি খুশি নন. ছোট বেলা থেকেই তার মধ্যে গরিব দুঃখীদের সেবা করার, তাদের মুখে হাসি ফোটানোর একটা দৃঢ় ইচ্ছা ছিল. কিন্তু ডাক্তার হয়েও কলকাতায় তিনি নিজের এই ইচ্ছাটা সফল করতে পারছিলেন না. তাকে এখানে রুলস আর রেগুলেশন এর মধ্যে দিয়ে চলতে হয়. তিনি সচ্ছল ভাবে এখানে কাজ করতে পারছিলেন না. কারণ তার মনে সেবা করার ভাবনাটা এখনো রয়ে গেছেন. তিনি তার স্ত্রীকে বলেন : স্নিগ্ধা, যদি সবাই শহরে ডাক্তারি করে.... তাহলে গ্রামের ওই গরিব লোক গুলোর কি হবে বলতো?
স্নিগ্ধা বলে : তুমি একদম ঠিক কিন্তু এখানে তোমার অনেক সুযোগ আছে যেটা ওখানে নেই.
স্নিগ্ধা, দুই সন্তানের জননী. প্রথম জন আট বছরের আর দ্বিতীয় জন এখনো দুধপান করে. অর্ণব আর সুজয়. অর্ণব বড়ো. তাদের মা অসাধারণ রূপের অধিকারিণী. দুই সন্তানের মা হয়েও শরীরে কোনো সৌন্দর্যের অভাব নেই. রমলা দেবী যখন অনিমেষ বাবুকে স্নিগ্ধার ছবি দেখিয়ে ছিল ওই টানা টানা চোখ দেখেই অনিমেষ বাবু হা বলে দিয়েছিলেন. তারা দু পক্ষই বড়ো ঘরের. আজ স্নিগ্ধা আর অনিমেষ বাবু সুখী দাম্পত্য জীবনের অধিকারী কিন্তু তারা জানতেন না এই সুখী জীবনের ওপর নেমে আসবে কালো ছায়া, তাদের দাম্পত্য জীবনে নজর পরতে চলেছে কালো এক ছায়ার.
অনিমেষ বাবু একদিন ঠিক করে ফেললেন না.... আর নয় এইভাবে আর চলতে পারেনা. জীবনে স্বার্থ, অর্থ থেকেও সেবা বড়ো. তিনি এই শিক্ষা তার দাদুর থেকে, বাবার থেকে পেয়ে এসেছেন. তাই তিনি একদিন তার এক বন্ধুরা প্রতুল কে তার মনের কথা বলেই ফেললেন. প্রতুল তাকে জানালো সে যদি চায় তাহলে সে তার মনের ইচ্ছা পূরণ করতে পারে. অনিমেষ বাবু তো হাতে চাঁদ পেলেন. তিনি প্রতুল কে বললেন তিনি রাজি. গরিব মানুষ গুলোর সেবা করে তার আত্ম তৃপ্তি. টাকা পয়সার কোনো অভাব কোনো দিনই ছিলোনা অনিমেষ বাবুর. তাই সেবাতে নিজের মন দিতে চান. নিজের শিক্ষাকে সেবার কাজে লাগাতে চান. প্রতুল তার কথা শুনে বললো : ভাই.... তোর মতো যদি সব ডাক্তার হতো তাহলে......... থাক.... তুই যখন এটাই চাইছিস তখন আমার জানা একটা গ্রাম আছে. ওখানে কোনো ডাক্তার থাকতে চায়না... আসলে সবাই শহরকে আপন করতে চায়. তাই আগের ডাক্তারও দিয়েছে লম্বা. তা তুই ওখান দিয়েই নিজের যাত্রা শুরু কর. অনিমেষ বাবু তো এককথায় রাজি. কিন্তু বাসস্থান তো দরকার, সেই ব্যাপারে প্রতুল কে জিজ্ঞাসা করাতে সে বললো : কোনো অসুবিধা নেই. ওইগ্রামে আমার এক বন্ধুর একটা জমিদার বাড়ি আছে. যদিও সেই বাড়ি আজ পরিত্যক্ত. কিন্তু আমি ওকে বলবো যাতে ও ওখানকার সব কিছু পরিষ্কার করিয়ে রাখে. আসলে ওদের পরিবারই একটা ছোট হাসপাতাল খুলে ছিল কিন্তু ঐযে সব ডাক্তার শহরে পালিয়ে যায়. এবার তুই ভেবে দেখ. অনিমেষ বাবু বললেন সব ব্যাবস্থা যখন হলোই তখন তুই তোর বন্ধুরা সাথে কথা বলে দেখ. দু দিন বাদে ওই বন্ধুর সাথে প্রতুল অনিমেষ বাবুর দেখা করিয়ে দিলেন. তার নাম অঞ্জন ভট্টাচার্য. তিনি বললেন জমিদার বংশের সন্তান তিনি কিন্তু তার জন্ম শহরেই. তিনি নিজে কয়েকবার মাত্র গেছেন ওই গ্রামে. তবে তার বাবার ওই গ্রামে অনেক influence আছে. তাই তার এক কোথায় গ্রামের লোকেরা সব ঠিক থাক করে দেবে.
অঞ্জন : সত্যি আপনার মতো মানুষকে আমি খুজছিলাম. গ্রামের হাসপাতালটা পড়ে আছে, কেউ দেখার নেই. আপনি থাকলে ভালোই হবে. আপনার থাকা খাওয়ার কোনো অসুবিধা হবেনা. পুরো বাড়িটাই আপনারা ব্যবহার করতে পারবেন. কিন্তু.........
অঞ্জন বাবুর কিন্তু শুনে আর একটু চিন্তিত মুখ দেখে অনিমেষ বাবু বললেন : কি হলো অঞ্জন বাবু? একটু চিন্তিত মনে হচ্ছে?
অঞ্জন : আসলে ব্যাপারটা কিছুই নয়. আমরা শহুরে লোক. আমরা যদিও এসব মানিনা. আমার বাবাও মানেনা. কিন্তু গাঁয়ের লোকেরা বলে বাড়িটাতে নাকি গোলমাল আছে.
অনিমেষ : গোলমাল? কি গোলমাল মানে চুরি টুরির কথা বলছেন?
অঞ্জন : আরে না দাদা..... আসলে লোকে বলে বাড়িটা নাকি Haunted. অনেক আওয়াজ ভেসে আসে নাকি..... যদিও আমি ঐসব ফালতু কোথায় কান দিনা. গ্রামের অশিক্ষিত কিছু লোকের ভুলভাল চিন্তাধারা. তবু আপনাকে এই ব্যাপারটা জানানো উচিত বলে আমি বললাম. আপনার কোনো অসুবিধা থাকলে.........
অনিমেষ বাবু অট্টহাসি হেসে উঠলেন. এইসব নিম্নমানের ব্যাপার তিনি মাথাতেই আনেননি. তিনি ভেবেছিলেন বোধহয় গ্রামে চুরি ডাকাতি হয়. তিনি অঞ্জন বাবুকে জানিয়ে দিলেন ঐসব প্রাগৈতিহাসিক চিন্তাধারাতে তার বিশ্বাস নেই. তিনি বিজ্ঞান জগতের মানুষ. তিনি স্পষ্ট ভাবে অঞ্জন বাবুকে জানিয়ে দিলেন তার কোনো অসুবিধা নেই ওই বাড়িতে থাকতে. এতো বড়ো একটা বাড়ি পাওয়া যাবে সেখানে তিনি ভালোই থাকবেন. সব কথার শেষে ঠিক হলো ওই বাড়িতেই থাকা হবে. হায়রে..... মানুষ মাঝে মাঝে এমন কিছু ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে যার ফলাফল হয় ভয়ানক.
তার এই সিদ্ধান্তের কথা যখন তিনি বাড়িতে জানালেন তখন প্রথমে সবাই আপত্তি করলো. বিশেষ করে স্নিগ্ধা. সে অনিমেষ বাবুকে বোঝালো কিন্তু তিনি তার সিদ্ধান্তে অটল. ছোট থেকেই তার মধ্যে সেবা করার একটা ইচ্ছা ছিল আজ সেই সুযোগ পেয়েও তিনি ছেড়ে দেবেন. না কখনোই নয়. শেষ মেশ এটাই ঠিক হলো তিনি যাবেন. এই ব্যাপারে তপন বাবু অর্থাৎ ওনার পিতাও একমত হলেন. তিনিও পরোপকারী মানুষ. ঠিক হলো অনিমেষ বাবু আগে গিয়ে সব সাজিয়ে গুছিয়ে নেবেন. তারপর তিনি সপরিবারে সেই বাড়িতে যাবেন. কিন্তু অনিমেষ বাবুর স্ত্রী স্বামীকে ওই অচেনা জায়গায় একা ছাড়বেনা. আবার ওনার বাবা মায়ের যাওয়া হবেনা. তাদের বেশি বাইরে ঘোরা ঘুরি মানা. তাই ঠিক হলো যে কটা মাস তিনি ওই গ্রামে সেবা করবেন সেই কটা দিন তারা তাদের ছোট ছেলের কাছে চলে যাবেন. ওদিকে অর্ণব এর স্কুলে কয়েকদিন পরেই ছুটি পড়বে. গরমের ছুটি. তখনি রওনা হওয়া যাবে. তাহলে সবাই যেতে পারবে একসাথে. অনিমেষ বাবু সেই মতো বড়ো কর্তাদের জানালেন. সেখানকার বড়ো একজন তাকে সাহায্য করলো তাকে সব কাজে. ঠিক হলো যাত্রার দিন. অঞ্জন বাবুও সস্ত্রীক বাচ্চাদের নিয়ে একেবারে অনিমেষ বাবু কে নিয়ে একবার ঘুরে আসবেন বাড়িটা থেকে. নিজেও দেখে আসবেন বাড়িটা.
এসে গেলো সেইদিন. অনিমেষ বাবু স্ত্রী সন্তানকে নিয়ে বাবা মাকে প্রণাম করে বেরিয়ে পড়লেন ওই বাড়ির পথে. স্টেশনে গিয়ে দেখলেন অঞ্জন বাবু সঙ্গে একটা বাচ্চা. বোধহয় ওনার ছেলে. এগিয়ে গিয়ে পরিচিত হলেন একে ওপরের সাথে. অঞ্জন বাবু বললেন তার স্ত্রীয়ের শরীরটা একটু খাড়াপ তাই তিনি ছেলেকে নিয়েই এসেছেন. তারা ট্রেনে গিয়ে বসলো. দুই বাচ্চা একসাথে বসলো. অঞ্জন বাবুর ছেলের নাম চয়ন. চয়ন আর অর্ণব দ্রুত বন্ধু হয়ে গেলো. ওরা গল্প করতে লাগলো. বড়োরাও গল্প করতে লাগলো. দীর্ঘ 4 ঘন্টার পথ. স্টেশনে যখন গাড়িটা থামলো তখন সন্ধে 6 টা বেজে গেছে. স্টেশনে আগেই বলা ছিল. লোক আগেই ওনাদের নিতে এসেছে. অর্ণব দেখলো একজন বুড়ো লোক সঙ্গে দুজন কুলি. অঞ্জন বাবু পরিচয় করিয়ে দিলেন ওনার সঙ্গে. উনি গ্রামের একজন বিশিষ্ট মানুষ. নাম জগবন্ধু দাস. ওনার সঙ্গে অঞ্জন বাবুর বাবা মিলেই ওই হাসপাতাল বানিয়ে ছিলেন.
জগবন্ধু বাবু বললেন : এই গ্রামে নিজের থেকে যে কোনো ডাক্তার আসবে সেটা তিনি ভাবতেই পারেননি. তিনি বললেন আজতো সন্ধে হয়ে গেছে তাই কাল অনিমেষ বাবুর উদ্দেশে একটি স্বাগতম অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়েছে. ওই একটু বক্তৃতা আর ওনার সম্মানে একটু মিষ্টি বিতরণ. জগবন্ধু বাবু কুলিদের বললেন সব মল পত্র ঠিক মতো গাড়িতে তুলে দিতে . তিনি আগেই গরুর গাড়ির ব্যবস্থা করে রেখে ছিলেন. তিনি সকলকে নমস্কার বলে চলে গেলেন. সবাই দুটো গরুর গাড়িতে চড়ে আসতে লাগলেন. 10 মিনিটের মধ্যেই তারা ওই বাড়িটাতে পৌঁছে গেলেন. বাড়িটা বিশাল কিছু না হলেও বেশ বড়ো. তিন তলা. টিপ টিপ করে হারিকেনের আলোয় জানলা গুলো আলোকিত. অঞ্জন বাবু নেমে হাঁক পারলেন. আর দুইজন লোক বেরিয়ে এলো. একজন মেয়েমানুষ আরেকজন লম্বা করে লোক. অঞ্জন বাবু ওনাদের সঙ্গে অনিমেষ বাবুর পরিচয় করিয়ে দিলেন. মেয়েমানুষটির নাম মালতি আর লোকটি তার বর তপন. দুজনেই পেন্নাম করলো তাদের. অর্ণব দেখলো তপন লোকটি কেমন করে যেন তার মায়ের দিকে চেয়ে আছে. ওর মা লক্ষ্য করছেনা কারণ সে অনিমেষ বাবুর সঙ্গে কথা বলছে. তপন ওদের মল পত্র নিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলো আর পেছনে ওরা. মালতি ওদের জন্য কিছু জল আর খাবারের ব্যবস্থা করতে গেলো.
স্নিগ্ধা ওনার স্বামীকে বললো : বাব্বা..... জায়গাটা কি থম থমে গো. আসে পাশে সেইরকম বাড়ি ঘোরও নেই. ভাগ্গিস ইলেকট্রিক ব্যবস্থা আছে. নইলে এই জায়গাতে থাকতে কি করে?
অঞ্জন বাবু হেসে বললো : আসলে বৌদি কি এই বাড়িতে কেউতো থাকতো না...... ওই মালতি আর ওর বর বাড়ির থেকে দূরে ওই গ্রামে থাকে. আপনাদের জন্যই ওদের ডেকে পাঠালাম. ওরাই আমাদের বাড়িটার দেখভাল করে. আমরা যখনি আসি ওরাই আমাদের রান্না বান্না করে দিতো. তবে ওদের আমি বলে দিয়েছি এলং থেকে এই বাড়ির নিচেই থাকতে হবে. আপনাদের নতুন জায়গাতে তো এইভাবে একা ছেড়ে দিতে পারিনা. চলুন....
ওনাদের ওপরে দোতলায় থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে. অর্ণব দেখলো চয়ন কেমন করে ঘরটা দেখছে. যেন কিছু একটা ভয় পাচ্ছে. দোতলায় মাল পত্র রেখে সবাই বাইরে বারান্দাতে বসলো. একটু পরেই মালতি কিছু নিমকি আর মিষ্টি নিয়ে এলো. অঞ্জন বাবু জিজ্ঞেস করাতে মালতি বললো রাতের জন্য মুরগি আর লুচির ব্যবস্থা করা হয়েছে. সবাই বসে গল্প করতে লাগলো. চয়ন আর অর্ণব খেলতে লাগলো. দুজনে কম সময়েই বন্ধু হয়ে গেছে.
স্নিগ্ধা : বুবাই (অর্ণবের ডাক নাম) পরে খেলবে আগে খেয়ে নাও.
তারা খেলা ছেড়ে খেতে লাগলো নিমকি. গল্প করতে করতে রাত 10 টা বেজে গেলো. মালতি বললো খাবার ব্যাবস্থা করা হয়েছে. সবাই নীচে রান্না ঘরের পাশে খাবার ঘরে গেলো. সেখানে একটা পুরোনো খাবার টেবিল আছে. আর 4টা চেয়ার. বাচ্চারা দাঁড়িয়ে খেলতে খেলতে খেতে লাগলো. স্নিগ্ধা বুবাই কে খাইয়ে দিচ্ছে ওদিকে অঞ্জন বাবু চয়ন কে. মালতি বেশ ভালোই রান্না করে. খাবার পর অঞ্জন বাবু নিচ তোলাটা ওদের ঘুরিয়ে দেখালো. একটা ঘরে ওই মালতি আর তপন. আর বাকি ঘোর গুলোতে পুরোনো মল পত্র.
অনিমেষ বাবু অঞ্জন বাবুকে বললেন : এই বাড়ি কার বানানো?
অঞ্জন বাবু একটা সিগারেট ধরালেন আর বললেন : আমার দাদুর দাদু. অমর ভট্টাচার্য. লোকটা বেশ দিল দরিয়া ছিল.... কিন্তু তার ছেলে একেবারে বিপরীত.
অনিমেষ : মানে?
অঞ্জন : সে কালকে বলব. আজ অনেক খাটাখাটনি গেছে. বৌদি বাচ্চার নিশ্চই ঘুম পেয়েছে. চলুন.... চলুন.
সবাই উপরে উঠে এলো. তখনি কোলের বাচ্চাটা কেঁদে উঠলো. স্নিগ্ধা অনিমেষ আর অঞ্জন বাবুকে শুভরাত্রি বলে ঘরে চলে গেলো. তাকে এখন বাচ্চাটাকে দুধ খাওয়াতে হবে. বাচ্চারা অঞ্জন বাবুর ঘরটাতে বসে একটা ফুটবল নিয়ে. বাইরে তাদের বাবারা সিগারেট টানছে আর গপ্পো / আড্ডা মারছে. অর্ণব দেখলো চয়ন তাকে কিছু একটা বলতে চাইছে কিন্তু কেন যেন চেপে যাচ্ছে. তখনি স্নিগ্ধা ঘর থেকে ওদের শুতে আসতে বললো. অনিমেষ বাবু অঞ্জন বাবুকে শুভরাত্রি বলে ছেলেকে নিয়ে চলে এলো ঘরে. সারাদিন যাত্রার ধক এ সবাই ক্লান্ত. জামা কাপড় বদলে সবাই শুয়ে পরলো. স্নিগ্ধা আগেই শাড়ি পাল্টে একটা ম্যাক্সি পরে নিয়েছে. সবাই শুয়ে পরলো. আর একটু পরেই ঘুম. রাত গভীর. বাইরে শেয়াল ডাকছে. জানলা দিয়ে চাঁদের আলো ঘরে ঢুকে ঘর আলোকিত. পাখা ঘুরছে. খাটের দুপাশে অনিমেষ আর স্নিগ্ধা. মাঝখানে দুই সন্তান. হটাৎ বুবাইয়ের ঘুমটা কেন যেন ভেঙে গেলো. ও চোখ খুলতেই দেখলো কে যেন ওর ডান পাশে দাঁড়িয়ে. ওই পাশেই ওর মা ঘুমোচ্ছে. বুবাই একটু নড়ে উঠতেই আর কিছু দেখতে পেলোনা. ও ভাবলো চোখের ভুল তাই আবার চোখ বুজলো. ওদিকে পাশের ঘরে চয়ন ঘুমিয়ে তার বাবার সাথে. তারা কালকেই চলে যাবে সন্ধে বেলায়. চয়ন তাড়াতাড়ি মায়ের কাছে যেতে চায়. সে এইবাড়িতে বেশিক্ষন থাকতে চায় না.
পরের দিন সকালে সবাই উঠে চা খাচ্ছে. অর্ণব আর চয়ন বাইরে বাগানটা ঘুরে ঘুরে দেখছে. যদিও বাগানটি ঠিক করে পরিচর্যা করা হয়না. কেই বা করবে. তাই সুন্দর ফুল গুলোকে উপেক্ষা করে জংলী গাছ আর জংলী ফুল গজিয়ে উঠেছে. তাদের মাঝে ওই ফুল গুলোর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য চাপা পরে গেছে. ওরা বাগানটা ঘুরে দেখে যেই ফেরার জন্য ঘুরেছে ওরা দেখলো ওদের পেছনে তপন দাঁড়িয়ে আছে. ওদের দিকে চেয়ে হাসছে. সে এগিয়ে এসে বললো : কি খোকাবাবুরা..... বাগান দেখছো? দেখো দেখো. তারপর চয়নের কাছে গিয়ে ওর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বললো : তা এইবার এতো পরে এলে খোকাবাবু? তোমার কথা কত ভাবতাম আমি. তা তোমার মা এলোনা কেন? উনি আসলে আরো ভালো লাগতো. কি তাইনা? বলে বাগানের পাশের রাস্তা দিয়ে কোথায় চলে গেলো. অর্ণব চয়নের দিকে তাকালো. ও দেখলো চয়নের চোখে মুখে কেমন একটা ভয়. ও চয়ন কে কিছু বলতে যাচ্ছিলো তখনি ওর মা ওদের ডাক দিলো. ওরা যেতেই মালতি ওদের জন্য লুচি তরকারি নিয়ে এলো. ওরা চুপচাপ খেতে লাগলো. অঞ্জন বাবু চা খেতে খেতে স্নিগ্ধা কে বললো : তা বৌদি.... কাল কোনো অসুবিধা হয়নি তো? আসলে নতুন জায়গা তো সেইজন্যে. স্নিগ্ধা হেসে বললো : না... না কোনো অসুবিধা হয়নি খুব ভালো ঘুম হয়েছে. নতুন জায়গায় সচরাচর আমার ঘুম আসেনা কিন্তু কাল খুব ভালো ঘুম হয়েছে. একটু পরেই চা খাওয়া হয়ে গেলে অঞ্জন বাবু আর অনিমেষ বাবু বেরোনোর জন্য তৈরী হয়ে নিলেন. একটু পরে দুজনে বেরিয়ে গেলেন. জগবন্ধু বাবু ওনাদের জন্য গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলো. ওদিকে স্নিগ্ধা ছোট ছেলেকে নিয়ে ওপরে চলে গেলো আর দুই বাচ্চা দালানে ফুটবল খেলতে লাগলো. ওরা খেলছে তখনই অর্ণব দেখলো তপন ছুট্টে ঘরে ঢুকে উপরে উঠে গেলো. চয়নও সেটা দেখলো. তারপর তারা আবার খেলতে লাগলো. ওদিকে অঞ্জন বাবু আর অনিমেষ বাবু হাসপাতালে পৌঁছে দেখলো তাদের জন্য জগবন্ধু বাবু আর বেশ কয়েকজন সেখানে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে. সেখানে গ্রামের অনেক লোক এসেছেন. নতুন ডাক্তার বাবুকে পেয়ে তারা খুব খুশি. মালা পরিয়ে তাকে সম্মান জানানো হলো. গ্রামের বিশিষ্ট কিছু মানুষ তাকে সম্মান জানালেন তার সাথে অঞ্জন বাবুকেও. কারণ এই হাসপাতাল বানাতে তাদের পরিবারের অনেক অবদান আছে. অনিমেষ বাবু গ্রামের লোকেদের উদ্দেশ্য কিছু বক্তৃতা দিলেন. তারপর সামান্য মিষ্টিমুখ হলো. সবশেষে হাসপাতাল ভালো ভাবে ঘুরে দেখার পর দুপুর বেলাতে সব লোক চলে গেলে অনিমেষ বাবু, অঞ্জন বাবু, জগবন্ধু বাবু আর গ্রামের প্রৌঢ় অচিন্ত বাবু বসে আড্ডা দিচ্ছে. হটাৎ অচিন্ত বাবু প্রশ্ন করলেন : অঞ্জন তুমি ডাক্তার বাবুকে তোমার ওই জমিদার বাড়িতে রেখেছো ভালো কথা কিন্তু.......
অনিমেষ বাবু হেসে বললেন : আপনি কি ভুতের ভয়ের কথা বলছেন? স্যার আমি ওসব মানিনা. আমি ওই বাড়িতেই থাকবো. আমার বা আমার পরিবারের কোনোই অসুবিধা হবেনা.
জগবন্ধু বাবু একটু চিন্তিত হয়ে বললেন : সে সব ঠিক আছে. আমি আপনাকে থাকতে বারণ করছিনা.... আসলে অচিন্ত বাবু বলতে চাইছেন বাড়িটা নিয়ে যেভাবে গ্রামের লোকেরা বলাবলি করে তার ওপর অনেক দুর্ঘটনা ঘটে গেছে বাড়িটার ওপর দিয়ে.
অনিমেষ : কি দুর্ঘটনার কথা বলছেন.
অচিন্ত : বাবা অঞ্জন.. তুমিই বলোনা. তোমাদের বাড়ি... আমি বলাটা ঠিক হবে না.
অঞ্জন বাবু : আমি বাবার মুখে যতটা জানি তাই বলছি. আমার জন্ম কলকাতায় তাই আমি এই বাড়ির সঙ্গে আমার কোনো অতীত জড়িয়ে নেই. বাবা এখানেই বড়ো হয়েছে. হা এটা ঠিক এই বাড়িতেই অনেক অঘটন ঘটে গেছে. আমার বাবার দাদা মানে আমার জেঠু তার ছোটবেলাতেই এই বাড়িতেই মারা যান. তাছাড়া ঐযে বলেছিলাম আমার দাদুর দাদু তার ছেলে অরিন্দম ভট্টাচার্য ছিল খুব রাগী স্বভাবের মানুষ. সে নাকি কাকে খুন করেছিল. তাছাড়া এই বাড়িতে নাকি বাচ্চাদের বলি দেওয়া হয়েছে. যদিও আমি সেসব ভালো ভাবে জানি না.
অচিন্ত বাবু : আমি জানি..আমি বলছি. অমর ভট্টাচার্যের ছেলে অরিন্দম ছিল রাগী স্বভাবের. কিন্তু বাবা ছিল শান্ত হাসি খুশি স্বভাবের আর ভগবানে বিশ্বাসী মানুষ. ছেলের যখন বিয়ের বয়স হলো তখন তাকে পাশের গ্রামের এক সুন্দরী মহিলার সাথে বিবাহ দিয়েছিলেন. তার বৌমার নাম ছিল সুজাতা. খুব সুন্দরী ছিল সে. একবার অমর বাবু এক সন্ন্যাসী গোছের মানুষকে এই বাড়িতে নিয়ে আসেন. পরে অবশ্য জানা গেছিলো সে তান্ত্রিক. পিশাচ সিদ্ধ. সব রকমের কু কাজে যুক্ত. অনেক শক্তি ছিল নাকি তার. তখন অবশ্য কেউ কিছু জানতোনা. অমর বাবু ভক্তি ভাব নিয়ে তাকে নিয়ে আসেন. তার ছেলের যদিও এইসবে মনোযোগ ছিলোনা. অমর বাবু তার বৌমাকেই বলেছিলো বাবাজির সব রকমের খাবার দাবারের ভার নিতে. সুজাতা সেই মতো বাবাজির সেবা করতো. এক সময়ে অরিন্দম দেখলো তার স্ত্রী ওই বাবাজির একটু বেশিই খেয়াল রাখছে. নিজেই সব খাবার দিয়ে আসে, খাবার পর নিজেই সেই সব পাত্র আনতে যেত. অরিন্দমের সেসব ভালো লাগতোনা. ততদিনে তাদের একটা মেয়ে হয়েছিল. তবে অমর বাবু চাইতেন যেন বৌমার একটা ছেলে হয়. ওই তান্ত্রিক তাকে আশ্বাস দিয়ে ছিল যে তার বৌমার ছেলে হবে. তবে তাকে নাকি বড়ো যোগ্য করতে হবে. এই কাজে তাকে তার বৌমাকে আর তার মেয়েকে লাগবে. আর যতক্ষণ যোগ্য চলবে কেউ যেন ওই ঘরে না আসে. অমর বাবু রাজি হন. ওদিকে অরিন্দম এইসব ভন্ডামিতে একটুও বিশ্বাস করতোনা. সে ঠিক করলো সে লুকিয়ে ওই যোগ্য দেখবে. অবশেষে যজ্ঞের দিন এলো. রাতের বেলা নিচের যে ঘরে তান্ত্রিক থাকতো সেই ঘরেই যোগ্য শুরু হয়. সারারাত নাকি যোগ্য হবে. সবাই শুয়ে পড়েছে কিন্তু অরিন্দম জেগে ছিল. সে ভেবেছিলো ওই ভন্ড লোকটার ভণ্ডামি সবার সামনে নিয়ে আসবেন. সেই মতো তিনি চুপ চাপ উঠে নীচে নামেন. নীচে এসে সে তান্ত্রিকের ঘরের কাছে এসে তার স্ত্রীয়ের গোঙানি শুনতে পান. তিনি দৌড়ে গিয়ে দরজায় লাথি মেরে খোলেন আর যা দেখেন তা ছিল বীভৎস. তার একমাত্র মেয়ের মৃতদেহ পরে আছে আর তার স্ত্রী সুজাতা আর তান্ত্রিক নোংরামো করে চলেছে. নিজের স্ত্রীকে ওই ভাবে তান্ত্রিকের সাথে দেখে রাগী অরিন্দম আরো রেগে যায় আর তান্ত্রিক কে গুলি করে মারেন. ওদিকে তান্ত্রিক নাকি মরার আগে বলে যায় তার এতদিনের কাজে বাঁধা দিয়ে সে ঠিক করেনি তান্ত্রিক বলে সে এইবাড়ির মহিলাদের ছাড়বেনা.... তার যোগ্য সে পূর্ণ করেই ছাড়বে. তার মৃত্যু নেই. সে বার বার ফিরে আসবে. এদিকে স্ত্রীয়ের জ্ঞান ফিরতেই সে এইসব দেখে অজ্ঞান হয়ে যায়. পরে জানা যায় তান্ত্রিক তার শক্তি বাড়ানোর জন্য ছোট বাচ্চাদের বলি দিতো. এখানে এসে সুজাতা আর তার বাচ্চাকে দেখে তার সেই ইচ্ছা বেড়ে যায়. একদিকে নতুন বাচ্চা আরেকদিকে সুজাতার রূপে তান্ত্রিক পাগল. সে ঠিক করে সুজাতাকে বশ করে তাকে ভোগ করবে আর সুযোগ বুঝে তার বাচ্চাকে বলি দেবে. কিন্তু তার পরিকল্পনা পূর্ণ হবার আগেই অরিন্দম তাকে খুন করে. সবাই বলে সেই তান্ত্রিক এর আত্মা আজও নাকি এইবাড়িতে ঘোরাফেরা করে.
সব শুনে অনিমেষ বাবু বললেন : বুঝলাম.... বাড়িটাতে এরকম একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে আর তাই লোকেরা মনে করে ভুত ঘুরে বেড়ায়. যতসব কুসংস্কার. আমি এসব মানিনা. আরেকটা কি দুর্ঘটনার কথা বলছিলেন.
অঞ্জন বাবু বললো : ওটা আমি বলছি. আমার বাবারা ছিল তিন ভাই. বাবা মেজো. ছোটকা কলকাতায় থাকে. জেঠু তার ছোটবেলাতেই মারা যান. বাবা তখন ছোট বোধহয় 6 বছরের মতো আর জেঠু 11 বছরের. সব ঠিকই ছিল কিন্তু কি করে যে একদিন সব কিছু গোলমাল হয়ে গেলো কেউ জানেনা. অরিন্দম তার মেয়েকে হারানোর পরে আবার বাবা হয়েছিলেন. এবারে দুই ছেলে হয়েছিল. তার নাম ছিল সুজিত ভট্টাচার্য আর রঞ্জন ভট্টাচার্য. রঞ্জন আমার দাদু কিন্তু সুজিত ছিল নাকি পাগল. মানে পরে পাগল হয়ে গেছিলো. তাকে ঘরে আটকে রাখা হতো . অনেকে বলে সেই নাকি জেঠুকে মেরে ছিল তখন থেকেই তার পাগলামি ধরা পড়ে. তবে কোনো প্রমান নেই বলে সে ছাড়া পেয়ে যায়. তারপর দাদু বাবা আর ছোটকাকে নিয়ে এই বাড়ি ছেড়ে দেয়. দাদু কর্মসূত্রে আগে বাইরেই থাকতেন. সুজিত একাই থাকতো এই বাড়িতে. সে বিয়ে করেনি. পরে একদিন সে মারা যায় বুড়ো হয়ে. অনেকে বলে সুজিত নাকি ওই তান্ত্রিক দ্বারা possessed ছিল. আমি বা বাবা যদিও এসব মানি টানি না. সে পরে পাগল হয়ে গেছিলো এটা হতেই পারে.
অনিমেষ : একদমই তাই. এই গ্রামে এরকম অনেক ঘটনা রটে যায়. যাকগে..... চলুন... এবার ফিরি. বিকেল হয়ে এলো. অনিমেষ বাবু আর অঞ্জন বাবু ওনাদের বিদায় জানিয়ে ফিরতে লাগলো. ওদিকে চয়ন তার একটা ঘটনা অর্ণব কে বলছে. তারা খেলছিল আর গল্প করছিলো. হটাত চয়ন বললো : তুমি তোমার মাকে বলো ওই তপন এর সাথে যেন বেশি কথা না বলে.
অর্ণব : কেন?
চয়ন : লোকটাকে আমার একদম ভালো লাগেনা. আমরা যখন আগের বছর এখানে এসে ছিলাম তখন লোকটাকে দেখতাম খালি মায়ের দিকে কেমন করে তাকাতো. আমার কেমন যেন লাগতো. মা যখন রান্না করতো তখন আমি প্রায় দেখতাম লোকটা রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে দেখতো. আমরা 10 দিন মতো ছিলাম কিন্তু শেষের কটা দিন মা যেমন কেমন হয়ে গেছিলো. কি যেন ভাবতো. আমার মনে আছে যেদিন আমরা এসেছিলাম তার পরেরদিন রাতের ঘটনা. আমি বাবা আর মা ঘুমিয়ে আছি. হটাৎ আমার ঘুমটা ভেঙে গেলো. চোখ খুলে দেখি মা কি যেন বলে চলেছে. আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না. কিন্তু কয়েকটা কথা বুঝতে পেরে ছিলাম. না....... আমি আর পারছিনা..... এবার আসুন...... আমার কাছে. এরমকম কিছু শব্দ. তারপরের দিন রাতেও মা এরকম বলছিলো. আমি মাকে জিজ্ঞাসা করলাম কি হয়েছে মা? মা হটাৎ ঘুম থেকে জেগে বললো : কৈ কিছু নাতো. তারপর ফেরার 2 দিন আগে আমি ঘুমোচ্ছি. হটাৎ কে যেন বললো ওঠো. তাড়াতাড়ি ওঠো. চলে যাও এখন থেকে. আমি ঘুম ভেঙে উঠে বসলাম. দেখি বাবা ঘুমোচ্ছে. মা পাশে নেই. আমি ভাবলাম বোধহয় বাথরুমে গেছে. কিন্তু অনেক্ষন না ফেরায় আমি ভাবলাম যাই. বাবাকে দেখলাম কিন্তু বাবার ঘুম খুব কড়া. তাই একাই বেরোলাম. দেখি বাইরের হারিকেনটা নেই আর নীচে কলঘরের দরজার ফাঁক দিয়ে একটা আলো আসছে. আমি বুঝলাম মা নীচে তাই ঘরে ফিরে আসছি হটাৎ মায়ের তীব্র চিৎকার. তারপর মাটিতে জল পড়ার শব্দ হলো. আমি বাবাকে ডাকতে যাবো তখনি দেখি দরজা খুলে বেরিয়ে এলো ওই তপন লোকটা. তারপর পেছন ফিরে কাকে দেখে হাসলো তারপর আড়মোড়া ভেঙে কোথায় চলে গেলো. আমি দাঁড়িয়ে রইলাম. একটু পরে দেখি মা ওই কলঘর থেকে বেরোলো. আর ওপরে উঠতে লাগলো. আমি ছুটে গিয়ে ঘরে শুয়ে পড়লাম. মা একটু পরে আমার পাশে শুয়ে পরলো. পরের দিন সকালে দেখি মা আর মালতি মাসি রান্না করছে আর তপনও ওদের সাথে গপ্পো করছে. আমাকে দেখে ওই তপন কেমন যেন রেগে তাকালো তারপর চলে গেলো. লোকটা যেন কেমন. পরের রাতে আমার ঘুম যদিও ভাঙেনি কিন্তু মনে হচ্ছিলো কে যেন বলছে আমায় চলে যাও.... তোমার মাকে নিয়ে চলে যাও. আমি ভাবলাম স্বপ্ন দেখছি. তারপর দিন সন্ধেবেলা আমাদের আসার কথা. বাবা গেছিলো ওই হাসপাতালে ঘুরতে. আমি একা ঘরে খেলছি. হটাৎ মনে হলো কে যেন ঘরে ঢুকলো. আমি এদিক ওদিক দেখলাম কিন্তু কিচ্ছু দেখতে পেলামনা. হটাৎ মনে হলো কানে এসে কে যেন বললো : তোমার মাকে বাঁচাও. আমি আবার এদিক ওদিক দেখলাম তারপর ভয় পেয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম. তারপর মা মা করে মাকে খুঁজতে লাগলাম. কিন্তু মা ওপরে ছিলোনা. আমি একতলায় এসে মা মা করে ডাকতে লাগলাম. দেখি ওই যে ঘরটা দেখতে পাচ্ছ ওই ঘরটা থেকে তপন বেরিয়ে এলো. তারপর মাকে দেখলাম বেরিয়ে আসতে. দুজনেরই সেকি হাসাহাসি. হটাৎ আমাকে দেখে মা রেগে মেগে এগিয়ে এলো তারপর বললো : নীচে কি করছিস? যা ওপরে যা. আমি আসছি. এতো ভীতু কেন তুই. পেছন থেকে তপন বললো : মায়ের কথা শোনো খোকাবাবু. দুস্টুমি করোনা. তারপর মা আমাকে বললো : যা ওপরে আমি তপনের সাথে কয়েকটা কথা বলেই আসছি. আমি ওপরে চলে এলাম. আমি অবাক হলাম. মা এখানে এসে প্রথমদিন তপনের সাথে কোনো কথাই বলেনি তাহলে আজ এতো কি কথা. তারপর দুপুরে বাবা ফিরে এলো. আর সন্ধেবেলা আমরা ফিরে এলাম. তবে মা বাবাকে বলছিলো আরো কদিন থেকে যেতে কিন্তু বাবা রাজী হয়নি. ফিরে এসে মাকে কদিন কেমন যেন মন মরা দেখতাম. তারপর বাড়িতে যেদিন পুজো হলো সেদিন থেকে দেখি মা আবার হাসি খুশি. তাই বলছিলাম কেন জানিনা ওই লোকটাকে আমার ভালো লাগেনা. তুমি তোমার মায়ের সাথে ওকে বেশি মিশতে দিওনা. এই বলে ওরা আবার খেলতে লাগলো. একটু পরেই ওদের বাবারা ফিরে এলো. দুপুরে ওরা খেয়ে দিয়ে একটা ঘুম দিলো. সন্ধে বেলায় অঞ্জন বাবু আর চয়ন ওদের বিদায় জানিয়ে চলে গেলো. রাতে মালতি মাংস আর ভাত রান্না করেছিল. খেতে খেতে কথাবার্তা হচ্ছিলো.
অনিমেষ বাবু বললেন : আমার তো জায়গাটা বেশ লাগলো. এখানে আমি ভালোভাবেই কাজ করতে পারবো. বুবাইটার এখন গরমের ছুটি. সেকটা দিন ও এখানে থাকবে তারপর ওকে বাবা মায়ের কাছে রেখে আসবো.
খাওয়া দাবার পরে মা বাবা বসে বারান্দায় গল্প করছে. বুবাই ঘরে বসে টিভি দেখছে. এখানে সব রকম ব্যাবস্থায় অঞ্জন বাবু করে দিয়ে গেছেন.
বুবাইয়ের মা অনিমেষ বাবুকে বললো : হা জায়গাটা বেশ ভালোই তবে...... কি জানতো... আমার কেমন যেন লাগছে. জানিনা কিভাবে নেবে তুমি ব্যাপারটা কিন্তু তুমি চলে গেছিলে সকালে. আমি একা ছিলাম বাচ্চা দুটো নীচে খেলা করছিলো. আমি বসে টিভি দেখছি আর ছেলেকে দুধ খাওয়াচ্ছি হটাৎ মনে হলো আমার পেছনে কে যেন হাত রাখলো. আমি ঘুরে দেখলাম কিন্তু কেউ নেই. আমি ভাবলাম মনের ভুল. তারপর দুপুরে ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে স্নান করতে গেছি স্নান করছিও হটাত মনে হলো আমার পিঠে কার যেন হাত আবার. আমি ঘুরে তাকালাম কিন্তু কিচ্ছু নেই. কি হলো বলতো?
অনিমেষ বাবু হেসে বললো : আরে ধুর...... তুমিও না. নতুন জায়গায়. নতুন পরিবেশ. সব কিছুই নতুন. তাই এসব মনে হচ্ছে. দেখবে ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে. অনিমেষ বাবু আজ যা শুনেছেন তার কিছুই স্নিগ্ধাকে জানালেন না. যদি আরো ভয় পেয়ে যায় তাই. একটু পরেই গল্প শেষে অর্ণবের বাবা এসে ওকে যে কথাটা বললো সেটা শুনে ওর খুব ভয় হলো.
বুবাই টিভি দেখছিলো. ওর বাবা এসে বললো : বুবাই তুই ওই পাশের ঘরটায় থাকতে পারবি? আসলে এই খাটটায় চার জন ধরছে না. তাছাড়া তুমি বড়ো হচ্ছ. আজ বাদে কাল তোমায় ওই বাড়িতেই দাদু দিদার সাথেই থাকতে হবে আমরা তো এখানে থাকবো. যদিও স্নিগ্ধা বললো একসাথেই শুতে কিন্তু এটা ঠিক ওই খাটে চার জন ধরে না. তাই শেষ মেশ ঠিক হলো ও একাই ওই ঘরে শোবে. তাই সেইমতো ওই ঘরে সবার ব্যবস্থা করা হলো. রাতে একা একা শুতে বুবাইয়ের ভয় হচ্ছিলো. তবে সেরাতে তার কোনো অসুবিধা হলোনা. পরের দিন সকালে উঠে সে তৈরী হয়ে বাইরে এলো. বাইরে এসে দেখলো বাবা বেরোচ্ছে. ছেলেকে টাটা করে অনিমেষ বাবু চলে গেলেন নিজের কাজে. বুবাই কে মালতি এসে খেতে দিয়ে গেলো. লুচি আর বেগুন ভাজা. সে খেতে লাগলো আর টিভি দেখতে লাগলো. স্নিগ্ধা বললো : বুবাই ভাই রইলো. আমি বাথরুমে যাচ্ছি. বলে সে নীচে চলে গেলো. বুবাইয়ের কিছুক্ষন পরেই খাওয়া শেষ হয়ে গেলো. সে হাত ধুয়ে প্লেট রেখে ভাইকে দেখে নিলো সে ঘুমোচ্ছে. তারপর ওপরে তিন তোলাটা ঘুরতে গেলো. ওপরে যেতেই দেখলো তপন একটা ঘরে কি যেন করছে. সে এগোতেই দেখলো তপন বেরিয়ে আসছে. তাকে দেখে তপন হেসে উঠলো. কি খোকাবাবু এখানে কি করছো? এখানে উঠনা. এখানে ভুত আছে হি... হি.... বলে সে চলে গেলো. সে দেখলো তপনের হাতে কালো মতো কি একটা ছিল. সে অতটা খেয়াল করলোনা. সে একটু ঘুরে ফিরে নীচে নেমে এলো. এসে দেখলো মা এখনো আসেনি. সে বারান্দায় দাঁড়ালো. বারান্দা দিয়ে নীচে বাথরুমের কিছুটা দেখা যায়. বুবাই দেখলো তপন এদিক ওদিক দেখে কল পরের পেছনের দিকে চলে গেলো. সে ঐখানটাতে দেখতে এতো ব্যাস্ত যে পেছনে আরেকজন এসে দাঁড়িয়েছে সেটা সে বুঝতেও পারেনি. সে ঘুরতেই চমকে উঠলো. একটা বাচ্চা তার থেকে একটু বড়োই হবে. তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে. হাসছে. বুবাই ভয় পেয়ে গেলো.
সে বললো : কে..... কে.... তুমি.
ছেলেটি বললো : আমি রাজু. এই বাড়িতে আগে থাকতাম. এখন অনেক দূরে চলে গেছি. মাঝে মাঝে এই বাড়িতে ঘুরতে আসি. তা দেখলাম তোমরা নতুন এসেছো. তাই এলাম গল্প করতে. তুমি কি দেখছিলে?
বুবাই বললো কৈ কিছুনা তো?
রাজু হেসে বললো আমি জানি তুমি ওই তপনকে দেখছিলে তাইতো?
বুবাই বললো : তুমি কিকরে জানলে.
রাজু বললো : আমি জানি. তোমার জায়গায় একদিন আমিও ছিলাম. আমার সাথে আমার ছোট ভাই. তারপর......
বুবাই : তারপরে? তারপরে কি গো?
রাজু বললো : শুনবে?
বুবাই : হা বলোনা. বলোনা.
রাজু : তাহলে ছাদে চলো. এখানে নয়.
দুজনে ছাদে যেতে লাগলো. ছাদ খোলাই ছিল. বুবাই আর রাজু ছাদে একটা জায়গায় গিয়ে বসলো. বুবাই তাকে গল্পটা বলতে বললো. সে শুরু করলো তার কাহিনী.
মন্তব্যসমূহ